মিলটনের সংসারে ৮৭ জন বৃদ্ধ বাবা মা ও ১৪ জন প্রতিবন্ধি শিশু সন্তান।
নিজস্ব প্রতিবেদক || বার্তা বাজার || প্রকাশিত: ৯:৫৯ অপরাহ্ণ, সোম, ১২ অক্টোবর ২০ ||
৭০ বছরের রহমত সাহেব, গ্রামের বাড়ী কুমিল্লা, ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা, স্ত্রী ও চার ছেলে সন্তানের জনক, চার সন্তানই সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সনামধন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই বৃদ্ধ পায়ে গ্যাংরিন রোগে ভুগছিলেন। ২০১১ সালে অবসরে আসার পরে শারিরীক অবস্থা খারাপ হয়। হাটাচলা বন্ধ হয়ে যায়, চিকিৎসার জন্য মাসে অনেক টাকা খরচ, তার উপর আবার অসুস্থজনিত সেবার প্রয়োজন। পেনশন সহ পেনশনের বই বিক্রি করে সমস্ত টাকা চার সন্তানের হাতে তুলে দেন। তবে তার চিকিৎসা আর সেবা কোনটিই তার স্ত্রী ও সন্তানেরা বহন করতে আগ্রহী না। সেবা যত্ন নেয়ার কেউ ছিল না তার পাশে। অনেক কষ্টে চলে আসছিলেন ফেনী সদরে। সেখান থেকে আশ্রয় হয় মিরপুরের দক্ষিণপাইক পাড়ার ব্লক- ডি, রোড-৮, বাসা-৪৬২, মিলটন সমাদ্দারের চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে। শুধু রহমত সাহেব নন, লন্ডন প্রবাসী ৫ ছেলেমেয়ের মায়ের আশ্রয় হয়েছে এখানে। এইরকমই অবস্থায় ২০১৪সাল থেকে অদ্য অবধি তিন শতাধিক বৃদ্ধ বৃদ্ধা বাবা মায়ের আশ্রয় হয়েছে মিলটনের সংসারে। একই সাথে কয়েক বছর আগে বস্তাবন্দী অবস্থায় ফেনী সদরের একটি ডাস্টবিনে ফেলে রেখেছিল অজ্ঞাত শিশু ময়নাকে। পরবর্তীতে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের মাধ্যমে উদ্ধার হয়ে আশ্রয়ে এসেছে মিলটনের সন্তান হয়ে। বর্তমানে এই রকম ১৪জন প্রতিবন্ধী শিশুর পিতা মিলটন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের রেজিষ্ট্রেশনকৃত প্রতিষ্ঠান চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার। শুধুমাত্র অসহায় ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের সেবা করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন বরিশালের উজিরপুরের জন সমাদ্দার ও ছবি সমাদ্দারের ছেলে মিল্টন সমাদ্দার। তাকে সহযোগীতা করছেন স্ত্রী মিঠু হালদার। তারা দুজনই নার্সিং ডিপ্লোমায় পড়ালেখা করেছেন। মিলটনের এই প্রতিষ্ঠানে অক্ষম বৃদ্ধরা বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার সুযোগ পান। যেসব বাবা-মাকে তাদের সন্তানেরা অবহেলা করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। যাদের শেষ ঠিকানা হয়তো রাস্তায়ই হতো। খেয়ে না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় হয়তো তাদেরকে পড়ে থাকতে হতো। মিল্টনের সংসারে এখন এরকম ৮৭ জন বাবা মা রয়েছেন। তাদেরকেই নিয়েই মিল্টন-মিঠু দম্পত্তির সংসার। এই সংসারে নেই কোনো অবহেলা, অশান্তি। আছে শুধু ভালবাসা। যেখানে এক হাড়ির ভাত ১০১ জন বাবা-মা ও তাদের সন্তানেরা মিলে মিশে খান।
যেভাবে যাত্রা শুরু: নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা শেষ করে মিল্টন সমাদ্দার চাকরি না করে ২০১২ সালের দিকে মিলটন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেডের কার্যক্রম শুরু করেন। ওই সময় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। স্ত্রী মিঠু হালদার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আই সি ইউতে সেবিকা হিসেবে চাকরি করছিলেন। মিল্টনের প্রতিষ্ঠান থেকে হাসপাতাল ফেরত অসুস্থ বয়ষ্ক রোগীদের বাসায় গিয়ে টাকার বিনিময়ে সেবা প্রদান করা হচ্ছিল। দুই বছরে তার প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার অভিজাত ঘরের অন্তত ১ হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠানের বয়স্ক রোগীদের সেবা দিয়েছে।
২০১৪ সালের আগস্ট মাসের রাতে এক রোগীর বাসা থেকে ফেরার সময় আগারগাঁয়ের ফুটপাতে ৯০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে পড়ে থাকতে দেখেন। বৃদ্ধকে দেখে তার বড্ড মায়া লেগে যায়। তিনি তাকে তুলে তার বাসায় নিয়ে আসেন। ওই বৃদ্ধের শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। শরীরের একটি অংশে সংক্রমণে পঁচন ধরেছিল। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে বাসায় রাখার মত অবস্থা ছিল না। বাসার আশেপাশের বাসিন্দারা তাকে অনুরোধ করেন বৃদ্ধকে অন্যত্র রাখার জন্য। পরে তিনি ভবনের মালিকের একটি টিনশেড বাসা ভাড়া নিয়ে বৃদ্ধকে সেখানেই রাখেন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। ওই টিনশেড বাসার অন্যান্য বাসিন্দারাও দুর্গন্ধে থাকতে পারছিলেন না। পরে তারাও মালিকের কাছে অভিযোগ করেন। উপায়ন্তর না পেয়ে মিল্টন মালিককে জানিয়ে দেন তার বাসা যদি কেউ ছেড়ে দেয় তাহলে তিনিই সেগুলো ভাড়া নেবেন। এভাবে এক বছরের মাথায় মিলটন ১৮ জন অসহায় বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীকে তুলে এনে টিনশেড ঘরে রেখে সেবা দিতে শুরু করেন। সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তিনি পরে একটি বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে সেখানে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত তিনি ৩২৫ জন বাবা, মা ও প্রতিবন্ধী শিশুকে সেবা দিয়েছেন। বর্তমানে ৪০ জন পুরুষ, ৪৭ জন মহিলা ও ১৪টি শিশু মিলিয়ে চাইল্ড ও ওল্ড কেয়ারে ১০১ জন সেবা গ্রহিতা রয়েছেন। দুটি বাড়ি নিয়ে ছোট বড় ৩৬টি কক্ষে তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী মিঠু হালদার ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটিতে ১জন চিকিৎসক, ৩ জন ব্যবস্থাপক, ৩ জন সেবিকা, ৪ জন রাধুনী, ৮জন ওয়ার্ড বয়, ৮ জন আয়া ২ জন দারোয়ান, ২ জন গাড়ীচালকসহ ৩১ জন বেতন ভুক্ত স্টাফ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন।
ব্যবস্থাপক সাধারণত ভিজিটরদের আপ্যায়ণ, বাজার করা ও বাবা মায়েদের দেখাশুনা করেন। মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট/নার্স ওষুধ খাওয়ানো, শরীর চেকআপ, অসুস্থতাজনিত ড্রেসিং করেন। নারী সেবিকা ও ওয়ার্ডবয়রা গোসল করানো, খাওয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করেন। ৪ জন রাঁধুনী তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন। খাবার মেনুতে সকালে রুটি, ভাজি ও ডিম দেয়া হয়। দুপুর ও রাতে সাদাভাতের সঙ্গে সবজি, মাছ ও মাংস দেয়া হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার একজন চিকিৎসক আসেন। বাকি সময়টুকু মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। চিকিৎসা সেবার প্রায় সব আয়োজন আছে এখানে। বছরের বিশেষ দিনগুলোতে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মিল্টন সমাদ্দারকে আগে থেকেই ফোন করে অনেকেই বলে রাখে সারাদিন এখানে বৃদ্ধ বাবা মায়েদেরকে নিয়ে তারা হাসি আনন্দ করবে। একসঙ্গে খাবার খাবে। অনেকেই বিবাহ বার্ষিকী বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানও এখানে করে থাকেন। ওই সময় পোলাও, বিরিয়ানিসহ নানান খাবারের আয়োজন করা হয়। শীতের মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কেউ শীত বস্ত্র পাঠায় আবার কেউ নগদ টাকা পাঠিয়ে দেন এখানে থাকা বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য। রোজার ঈদ ও কোরবানি ঈদে নগদ টাকা, কাপড়, গরুর মাংসসহ আরো অনেক খাদ্যদ্রব্য দিয়ে যায় মানুষ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতবস্ত্র, চাল, ডাল অসহায় গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেন মিল্টন সমাদ্দার।
সরজমিন যা দেখা গেল: সোমবার দুপুরে ওই চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে গিয়ে দেখা যায় গুছানো-পরিপাটি কক্ষগুলোতে সিংঙ্গেল খাটে অসুস্থ-বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা কেউ শুয়ে আছেন, কেউ বসে আছেন। পুরুষ-মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা থাকার কক্ষ। মিলটন রুমের প্রবেশ করেই বাবা বলে ডাক দিতেই ঘুমন্ত বাবারা জেগে উঠলেন। কেউ কেউ ক্ষোভ নিয়ে বসে আছেন। মিল্টন কথা বলতে চাইলেও তারা অভিমান করে বলছেন, দুদিন ধরে তুমি আমাকে দেখতে আসোনি তাই তোমার সঙ্গে কথা বলবো না। মিল্টন তখন তাদেরকে বুকে টেনে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলেন, বাবা খুব ব্যস্ত ছিলাম দুদিন। তাই আসতে পারি নাই। মহিলাদের কক্ষে মা বলে ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মিল্টনকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। একের পর এক কক্ষে প্রবেশ করে তিনি সব মা-বাবার শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিলেন। তবে অন্যরকম এক দৃশ্য দেখা গেলো শিশুদের থাকার কক্ষে গিয়ে সেখানে ১৪টি খাটে ১৪জন শিশুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কক্ষটিতে একটি টেলিভিশনে শিশুতোষ অনুষ্ঠান চলছে।
এ কক্ষের সোয়াত, রাতুল, তায়িবা, ময়না, টিয়া ও সৃষ্টি বেশ মজা করেই এই অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। মিল্টন ওই কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সব শিশুরাই তার কাছে আসতে চাইছিলো। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকায় সেটি আর সম্ভভ হয়নি। মিল্টন নিজেই তাদের কাছে গিয়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে কোলে তুলে নিলেন। মিল্টনের আদর পেয়ে তাদের উচ্ছ্বাস যেন আরেকটু বেড়েই গেলো। এযেন সন্তানের প্রতি অন্যরকম এক মমতা। এজন্য হয়তো সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মিল্টন মমতা কেটাগরিতে ২০১৯ সালে পুরস্কার পেয়েছিলেন। মিল্টন বলেন, এরা জানে না কে তাদের মা-বাবা। কোথায় তাদের বাড়ি। বিভিন্ন মাধ্যমে এই শিশুদের আমি পেয়েছি। তাদেরকে সেবাদানকারী এক সেবিকাকে তারা মা ও আমাকে বাবা বলেই চিনে।
যেভাবে চলছে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি: মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মিল্টন সমাদ্দার। অলাভজনক ও সেবা প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আয়, স্ত্রী বেতনের টাকা ও তার ফেসবুক পেইজ, ইউটিউব ফলোয়ারদের দানের টাকায় চলছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে তার প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধদের ছবি, ভিডিও, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রমের চিত্র দেখেই মানুষ বিকাশের মাধ্যমে কেউবা সরাসরি এসে সাহায্য করে। তবে খরচের বেশিরভাগ টাকাই আসে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে। মিল্টন সমাদ্দার এ বিষয়ে বলেন, বাসাভাড়া, বিদ্যুত, গ্যাস, পানি, কাপড়, খাবার, চিকিৎসা, ওষুধ, সার্জিক্যাল আইটেম, ৩১ জন স্টাফের বেতন সবমিলিয়ে মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। যেটা বহন করা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে বৃদ্ধ অসহায় মানুষদের আনার জন্য। কিন্তু সেটি জায়গা স্বল্পতার জন্য সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য সেবা দেয়া। তাই সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবে মিল্টন সমাদ্দার কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রতিবেদককে জানান, বর্তমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির জন্য বৃদ্ধ বাবা মাসহ শিশুদেও সঠিক পরিচর্যা, খাবার, ওষুধসহ বাসা ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি আরো জানান এ মাসে কোনভাবেই বাসা ভাড়া(২৬৫০০০)টাকা এবং কর্মচারীদের বেতন (৩৭০০০০)টাকা পরিশোধ করাসহ ওষুধ ক্রয় (৪৫০০০০)টাকা মূল্যমান পরিশোধ করে বৃদ্ধ বাবা মায়ের যত্ন নেওয়া সম্ভব হবে না। সে ক্ষত্রে সঠিক ওষুধ দিতে না পারলে এখানে মৃত্য মহামারি আকার ধারন করবে। সেই সাথে কর্মচারীরা বেতন না পেয়ে পরিচর্যার কাজ ছেড়ে চলে যাবে। আমার বৃদ্ধ বাবা মা মারা গেলে তাদের দাফন কাফন বা সৎকার করার অবস্থাটুকুও বর্তমানে নেই। আমার আয় থেকে বাবা মাদের খাওয়া দাওয়া ও বিভিন্ন পানি, বিদ্যুৎ বিল দিতেই আমি স্বর্বশান্ত।
কোনো সরকারি অনুদান এখনো পাইনা। মানুষ যা সাহায্য করে সেটি খুবই সামান্য। আর আমি শুধু এখানেই চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার পরিচালনা করছি না। এর বাইরে ২/১ মাস পরপরই পথশিশুদের বিনামূল্যে খাবার দেই। বন্যায় ভুক্তভোগীদের চাল, ডাল, তেল বিতরণ করি। শীতে শীতবস্ত্র বিতরণ করি। এ পর্যন্ত আমার বৃদ্ধাশ্রমের ৭৮ জনকে দাফন করেছি। এখানকার শিশুদেরকে আমরা কোরআন শিক্ষা দিচ্ছি। স্কুলের যাবার বয়স আসলে ভর্তি করে দেবো। তাদের মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার সামগ্রী ও খেলাধুলার সুযোগ করে দিচ্ছি। এছাড়াও প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দুস্থ্য গরীব মানুষ সহযোগীতার জন্য আমার কাছে ছুটে আসে। যাদের সামান্য সহযোগীতাটুকু করতে পারাটাও আমার জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাদেরকে সেবা দেয়া হচ্ছে: মিল্টন সমাদ্দার বলেন, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার এখানে ঠাঁই হয়েছে, সরকারি বড় কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে বেসরকারি চাকরিজীবি, শিক্ষক, ইউরোপ প্রবাসীদের পিতা-মাতা, পুলিশ অফিসার, ছোট-বড় ব্যবসায়ির। তবে আমি কোনো পেশাকে প্রাধান্য দিয়ে এখানে এনে কাউকে সেবা দেই না। যারা একেবারে অসহায়, বয়স্ক, শারীরিকভাবে অক্ষম মূলত তাদেরকেই আশ্রয় দেই। বিশেষ করে সন্তানের অবহেলার শিকার হয়ে যারা শেষ বয়সে এসে রাস্তায় নেমেছেন। বাঁচার তাগিদে অসুস্থ শরীর নিয়ে রাস্তায় শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়া থানা পুলিশ, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিকরাও অনেক অসহায় লোকের তথ্য দিয়েছেন যাদেরকে আমরা এনেছি।
চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামে একটি ফেসবুক পেজে ২৫ লাখ ফলোয়ারসহ আমার ফেসবুক পেইজে ১৮লক্ষ ফলোয়ার রয়েছে যারা আমাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানে। তারা কোথাও এরকম বৃদ্ধ অসহায় মানুষকে পেলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে আমাদের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে তুলে নিয়ে আসি।
মিলটন বলেন, তুলে আনার সময় আমরা এমনও লোক পেয়েছি যারা ফুটপাতে থাকতে থাকতে তাদের শরীর মাঠির সঙ্গে আঠার মত লেগেছিলো। অনেকদিন ধরে গোসল না করা এবং প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাদেরকে তুলে এনে ১০/১৫ বার সাবান দিয়ে গোসল করাই। মিল্টন বলেন, আমরা যাদেরকে নিয়ে আসি তাদের অনেকেই অসুস্থ থাকে। তাদের জন্য মাসে সার্জিক্যাল আইটেমই কিনতে হয় ৯০ হাজার টাকার। এছাড়া খাবার ওষুধ কিনতে হয় কয়েক লাখ টাকার। যে চিকিৎসক প্রতি বৃহস্পতিবার এসে চেকআপ করেন তাকে দিতে হয় মাসে ৪২ হাজার টাকা।
নানা প্রতিবন্ধকতা: জীবনের শেষ বয়সটা যেন নিরাপদেই কাটে এই চিন্তা থেকে মিল্টন এই প্রতিষ্ঠানটি খুলেছেন। কারণ তার মধ্যে ভয় কাজ করে। শেষ বয়সে যদি তার সন্তানেরা তার দায়িত্ব না নেয়। তাই তিনি জাতি-ধর্ম বর্ণ সব ভুলে গিয়ে সবাইকে ভালবেসে এই কাজ করছেন। বিশেষ করে বাবা মায়ের প্রতি তার ভাললাগা একটু বেশিই। তাইতো বরিশালের উজিরপুরে নিজ বাড়িতে বৃদ্ধ মা থাকা সত্বেও তিনি আরও শত শত বাবা মায়ের সেবা করে যাচ্ছেন। তার নিজ মায়ের পাশপাশি স্ত্রীও তাকে শক্তি-সাহস যোগাচ্ছেন। নিঃস্বার্থভাবে অসহায় বাবা-মায়ের জন্য কাজ করেও নানা প্রতিবন্ধকতার সন্মুখীন হতে হচ্ছে মিল্টনকে। খবর পেয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে একবার এক বৃদ্ধকে তুলে আনতে গিয়ে স্থানীয়দের মারধরের শিকার হয়েছিলেন তিনি। মানবদেহের অঙ্গ পাচার চক্রের সদস্য ভেবে তাকে মারধর করে স্থানীয়রা। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছিলো। পরে অবশ্য সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আসেন। এছাড়া ঢাকার জিগাতলায়ও তাকে মারধর করা হয়েছিলো। আর সর্বশেষ দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য এলাকার উঠতি ছেলেরা তার কাছে চাঁদা চেয়েছিলো। তাদের কথামত চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
মিলটন বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এ ধরণের একটি কার্যক্রম চালানোর জন্য মানুষ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। অনেক কষ্ট করে দুটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। যেভাবে আমার প্রতিষ্ঠানটি সারা বাংলাদেশে প্রসারিত হয়েছে অনেকেই ফোন দিয়ে বৃদ্ধ-অসহায় লোকের তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু জায়গা স্বল্পতার ও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে তাদেরকে আনতে পারছি না। এছাড়া আমরা অনেক সময় কাপড়ের সমস্যায় পড়ি। এতজন লোকের কাপড়-একসঙ্গে দিতে পারি না। তাই আমি অনুরোধ করবো যাদের অব্যবহৃত কাপড় আছে সেগুলো আমাদেরকে দিলে আমরা কাজে লাগাবো।
যা বললেন মিল্টন সমাদ্দার: কারো জীবনের শেষ বয়সে এসে এমন করুণ-অসহায় পরিস্থিতি আসুক এটা আমি কখনও চাই না। আমি চাই সন্তানেরা যেন বৃদ্ধ বাবা-মাকে অবহেলা না করে। শেষ বয়সে তারা যেন বাবা-মাকে পরম মমতা দিয়ে আগলে রাখে। কারণ সবার জীবনেই এই সময়টা আসবে। তাই আমরা এমন কিছু করবো না যাতে আমাদের সন্তানেরা আমাদেরকে রাস্তায় রেখে চলে যায়। একইসাথে সমাজের ধনী, অর্থশালী ব্যক্তিদের কাছে আকুল প্রার্থনা করি আপনাদের সাধ্যমত সামান্য সহযোগীতা করলে একশ একজন অভিভাবকহীন অসুস্থ্য অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু ও বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারব।