(প্রিয়.কম) বয়স ৭০ বছর। এ বয়সে আর দশটা মায়ের মতো তার থাকার কথা ছিল পারিবারের সান্নিধ্যে। কিন্তু আলো তারা বেগমের ভাগ্যটা সে রকম নয়। এ বয়সেও তাকে ‘মার খেতে হয়েছে’ ছেলের হাতে। মারধরের পর তাকে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। খবর পেয়ে একটি বৃদ্ধাশ্রমের লোকজন তাকে উদ্ধার করেছে। সেই বৃদ্ধাশ্রমেই এখন কাটছে তার দিন-রাত।
বিশ্ব মা দিবসে রাজধানীর মিরপুর থানাধীন দক্ষিণ পাইকপাড়া এলাকার একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়েদের খোঁজখবর নিতে যান এই প্রতিবেদক। সেখানেই দেখা মেলে আলো তারার মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত কয়েকজন নারী ও পুরুষের।
ওই বৃদ্ধাশ্রমটির নাম ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’। সেখানে এই মুহূর্তে বসবাস করছেন ৯ জন বৃদ্ধ ও ১৪ জন বৃদ্ধা। এই ২৩ জনের বেশির ভাগকেই রাস্তা থেকে নিয়ে আসেন বৃদ্ধাশ্রমের কর্মীরা। আর অন্যদের পরিচয় গোপন করে রেখে গেছেন তাদের স্বজনরা।
জীবন সায়াহ্নে এসে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হওয়া এই মানুষগুলো কেমন আছেন, পরিবার নিয়ে তাদের কী বক্তব্য, তা জানতে শুরু হয় আলাপ। শুরুটা হয় আলো তারাকে দিয়ে। তার মাথার পেছনে ক্ষতের চিহ্ন। এ কারণে মাথা ন্যাড়া করেছেন চিকিৎসকরা। শরীর শুকিয়ে কাঠ। শুয়েছিলেন একটি খাটে।
এই নারী তার ঠিকানা ও ছেলে-মেয়েদের বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি। তবে একটি ঘটনা মনে আছে তার।
‘খালি একটা রুটি খাইতে চাইলাম। তাই পোলাডা আমারে ধইরা মারল। মাইরা মাইরা রাস্তায় নামায় দিছে। রাস্তায় পইড়া আছিলাম’, বলেন আলো তারা।
ওই নারীর বিষয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থাপক কিশোর বালা জানান, প্রায় ২০ দিন আগে মধ্যরাতে এই বৃদ্ধাশ্রমে একটি মেয়ে ফোন করে জানায়, এক বৃদ্ধা পঙ্গু হাসপাতালের গেটের সামনে পড়ে আছেন। এরপর ওই রাতেই তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়। বৃদ্ধাশ্রমে আনার সময় তার মাথায় বেশ কিছু ক্ষত ছিল।
ক্ষতের কারণ জানতে চাইলে কিশোর বলেন, ‘তার ছেলের কাছে রুটি খেতে চেয়েছিল বলে ছেলে তাকে এভাবে মারধর করেছে। আর মারধর করে তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে। তবে ছেলের বা পরিবারের কারো নাম পরিচয় কিছুই বলতে পারেন না তিনি।’
দক্ষিণ পাইকপাড়ার ৮ নম্বর সড়কের ৪৬২ নম্বর বাসার নিচ তলায় ভাড়া করা কয়েকটি ফ্ল্যাটে নিজ উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তোলেন মিল্টন সামাদ্দার নামের এক ব্যক্তি। তিন বছর আগে অসহায় মানুষদের ঠাঁই দিতে তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
মা দিবসে কেমন ছিলেন তারা ২৩ জন
ওই বৃদ্ধাশ্রমটিতে গিয়ে দেখা যায়, ফটকের সামনেই দুজন নারী পাশাপাশি বসে গল্প করছেন। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। খুব সহজেই দেখে মনে হবে, তারা একে অন্যকে অনেক দিন ধরেই চেনেন। কিন্তু না, তাদের পরিচয় হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমটিতে মাত্র মাস দুয়েক আগে। বৃদ্ধাশ্রমটিতে প্রবেশের সময় হাতের বাম পাশে একটি কক্ষে চারটি খাট পাতা ছিল। এর মধ্যে তিনটিতে শুয়েছিলেন তিনজন বৃদ্ধ।
ওই তিনজনের একজন মুসলিম উদ্দিন। বয়স আনুমানিক ৭৫ বছর। তাকে নারায়ণগঞ্জের একটি রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে একজন খবর দেয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। এরপর সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়। নিজের পরিবার সম্পর্কে কোনো কথাই বলতে রাজি হননি তিনি।
মুসলিমের পাশের খাটে শুয়েছিলেন লালু মিয়া নামের ৮০ বছরের বয়সী এক ব্যক্তি। তার গল্পটা প্রায় একই।
প্রথম কক্ষটি পার হয়ে পরেরটিতে চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি খাট। আর এসব খাটের ওপর শুয়ে আছেন বিভিন্ন বয়সী নারী। খাটের পাশে যেতেই উঠে বসলেন বিবি খোদেজা নামের সত্তরোর্ধ্ব এক নারী।
খোদেজা জানান, মাসখানেক হয় এই বৃদ্ধাশ্রমটিতে এসেছেন তিনি। অনেক ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল তার। তবে বিয়ের পরে কোনো সন্তান হয়নি। ১৬ বছর আগে তার দিনমজুর স্বামীও মারা গেছেন। এরপর থেকে অন্যের বাসায় কাজ করে জীবন চলছিল তার। কিন্তু কিছুদিন আগে যে বাসায় কাজ করতেন, সেই বাসায় নারিকেল পড়ে তার হাত ভেঙে গেছে। হাত ভেঙে যাওয়ার পরে ওই বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলেন তিনি। অবশেষে তার ঠাঁই হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে।
অপর একটি ঘরে বৃদ্ধাশ্রমটিতে খাটের ওপরে বসেছিলেন রেনু বেগম। ৬৫ বছর বয়সী এই নারীকে কলেজ গেট থেকে এই বৃদ্ধাশ্রমটিতে রেখে গেছেন এক ব্যক্তি।
রেনু জানান, তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। সব বোনরা তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর একমাত্র ভাইয়ের ঘরেও ঠাঁই হয়নি তার। এ জন্য ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করতেন তিনি।
বৃদ্ধাশ্রমের কর্মকর্তারা যা জানালেন
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক কিশোর বালা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা এখানে অসহায় মা-বাবাদের রেখেছি। তারা সকলেই ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে এমন বাবা-মাদের আমাদের কাছে পাঠানো হয়। বেশির ভাগই রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসা।
আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিগত খরচে চালাচ্ছেন মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী। এখানে এই বাসাটি ভাড়া নিয়েই আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বরে। বৃদ্ধাশ্রমে এখন ছয়জন স্টাফ রয়েছেন, যারা সবসময় এই বৃদ্ধাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন।’
বৃদ্ধাশ্রমটির প্রধান নির্বাহী ও তত্ত্বাবধানকারী মিল্টন সমাদ্দার বলেন, ‘মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভে এবং এই অসহায় অসুস্থ, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মানুষগুলোর সেবাদানের নিমিত্তে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আমার স্ত্রী আমাকে প্রতিষ্ঠানটি তত্ত্বাবধানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে আজ প্রায় ৩ বছর হতে চলল। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় তিন বছর যাবত অসহায়, অসুস্থ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ব্যক্তিদের সেবা ও পরিচর্যা প্রদান করার তৌফিক মহান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।
মিল্টন বলেন, ‘আমার একক উদ্যোগে একটি মানসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রম কেন্দ্র পরিচালনা করা একেবারেই অসম্ভব। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে ও আপনাদের অনেকের সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ৬৩ জন অসহায় অসুস্থ বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ব্যক্তিদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থাসহ সেবা ও পরিচর্যা করে আসছি। বার্ধ্যক্যজনিত কারণে ইতোমধ্যে সাতজন ইন্তেকাল করেছেন।
অনেকে ফেসবুকে আমাদের প্রচার ও বিজ্ঞাপন দেখে তাদের পিতা-মাতা ও স্বজনদের নিতে এলে আমরা তাদের স্বজনদের তাদের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছি। এটি একটি অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
বৃদ্ধাশ্রমের প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আমরা চাই না বৃদ্ধাশ্রমের মতো এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। এ বিষয়টি একটি সমাজ ও দেশের জন্য লজ্জার। এই অবহেলিত মানুষগুলো নিরাশ্রয়ী হওয়ার জন্য কে দায়ী? ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র-সবাই দায়ী। এই বৃদ্ধ মানুষগুলোই তো আমাদের এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। এই দায় স্বীকার করে আমি দায়িত্ব নিয়েছি।
এ সকল অসহায় বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের পরিবার-পরিজন আছে কি না, আমি জানি না। বিভিন্ন স্থানে নিগৃহীত অসহায়ভাবে নিদারুণ কষ্টে পড়ে থাকা মানুষগুলোর মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা আল্লাহ আমাকে দিয়ে করিয়েছেন। তারা বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত কঠিন রোগে আক্রান্ত। আমি মনে করি, এই সকল বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে সেবা প্রদান করা আমার, আপনার সবার দায়িত্ব।’
প্রিয় সংবাদ/আজহার