চাপা অভিমানেও ঈদে মন পড়ে থাকে স্বজনদের কাছে || Md Jasim Uddin জসীম উদ্দীন || ১০ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৮ পিএম
৩২ বছরের চাকরি থেকে অবসরের দুই বছরের মাথায় স্ত্রীকে হারান স্কুলশিক্ষক মো. সেলিম। এরপর নেমে আসে অমানবিক মানসিক নির্যাতন। তবুও মেনে নিয়ে নিজের গড়া ভিটায় থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেহীন পরিবারে মেয়েরাই তাকে তাড়িয়ে দেয়। এক রাতে তার জায়গা হয় চট্টগ্রাম বায়জিদ থানার সড়কে।
সেখান থেকে খবর পেয়ে বৃদ্ধ সেলিমকে তুলে আনেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার। এরপর পাঁচ বছরে ১০টি ঈদ এই বৃদ্ধাশ্রমেই কেটেছে স্কুলশিক্ষক সেলিমের। বৃদ্ধ সেলিম বলেন, ঈদ এলে মন খারাপ হয়। মেয়ে-নাতীদের জন্য খারাপ লাগে। কিন্তু দুই মেয়ের কাছ থেকেই বেশি কষ্ট পেয়েছি। তাই কখনও আর বাড়ি ফিরতে মন চায় না। তবে এক পরিবার হারিয়ে আরেক পরিবার পেয়ে খুশি তিনি।
বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার বলেন, ঈদটা এখানে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মা’র জন্য অভিমানের, চাপা কষ্টের। ঈদ এলে বিষাদ নেমে আসে, কষ্টে ছেয়ে যায় মন। নতুন লুঙ্গি, ফতুয়া, কাপড়, গেঞ্জি-প্যান্ট, সুস্বাদু ও ভালো খাবারেও কাটে না তাদের বিষাদ। বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ মানেই বিষাদ-চাপা কষ্ট, কান্না আর আহাজারির গল্প।
রোববার (১০ জুলাই) ঈদের বিকেলে রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় (বাড়ি-৪৬২, সড়ক-৮ দক্ষিণ পাইপাড়া) ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, গরু কুরবানির মাংস বণ্টন চলছে। দুটি গরু আশ্রমের বাসিন্দাদের জন্য কুরবানি দেওয়া হয়েছে৷ তাছাড়া অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর পক্ষ থেকেও আশ্রমে আসছে মাংস।
আশ্রম সূত্রে জানা যায়, ১৩৫ জন বৃদ্ধ আর ৩০টি শিশু রয়েছে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমে। তাদের সেবায় রয়েছে ৬০ জন কর্মচারী। খরচ হয় প্রতি মাসে ২৮ লাখ টাকা। ছোট বিজনেস থেকে আসা আয়, শুভাকাঙ্ক্ষীদের দানের টাকায় চলে এই আশ্রম।
বৃদ্ধাশ্রমটিতে পাঁচ বছর ধরে থাকেন চট্টগ্রাম বায়জিদ থানা এলাকার বৃদ্ধ শিক্ষক মো. সেলিম। তিনি নিজের ঈদ নিয়ে বলেন, আগে ঈদ কত আনন্দের ছিল। স্ত্রী ছিল, দুই মেয়ে ছিল। স্ত্রী পরলোকে আর দুই মেয়ে থেকেও নেই।
নিজের কষ্টের রোজগারে বড় করা দুই মেয়ে চাকরি করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। আর দুই জামাই চাকরি করেন চট্টগ্রাম বন্দরে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এক রাতে পেনশনের সব টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে যায় মেয়েরা।
তিনি বলেন, ওরা জানে আমি এই আশ্রমে আছি। কিন্তু কোনোদিন ওরা কেউ আসেনি, খোঁজ নেয়নি। ওদের কথা আর মনে করতেও ইচ্ছে করে না, ফিরতে মন চায় না বাড়িতে। তবুও মানুষ তো, ঈদ এলে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে।
এক বুক অভিমান চাপা রেখেই বৃদ্ধ সেলিম বলেন, কখনোই ফিরব না, এখানেই ভালো আছি, এক পরিবার হারালেও এখানে বেশ ভালো আছি।
কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব আফসার আলীর সঙ্গে। ময়মনসিংহে রাস্তা থেকে তাকে তুলে আনা হয়। দীর্ঘদিন সড়কে পড়ে থেকে শরীরে পচন ধরেছিল। এখানে আনার পর এখন অনেকটা সুস্থ তিনি।
আফসার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্ত্রী আগেই ছেড়ে গেছে, এক ছেলে আছে। কোথায় কি করে জানি না। পরিবারের কথা, ঈদের স্মৃতির কথা বলতে তার আগ্রহ দেখা গেল না। নিরুৎসাহ থেকে তিনি বলেন, এখন আর কিছুই মনে পড়ে না।
একসময়ের প্রভাবশালী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী টিপুরও স্থান হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। ফরিদপুরের এই বাসিন্দা নিঃসন্তান হলেও স্ত্রীকে নিয়েই বেঁচে ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর শরীর-মন বেঁকে বসে এয়ারটেলের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার টিপুর। এক রাতে পড়ে যান গুলশানের সড়কে। এরপর চার বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমই তার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার পরিবার।
টিপু বলেন, আমার এখন কেউ নেই। নিঃসন্তান, স্ত্রীও মরে গেছে, ভাই-বোন, বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ নেই। মিল্টনই (পরিচালক) আজ পাশে দাঁড়িয়েছে ছেলের ভূমিকায়।
নোয়াখালীর নূরজাহানের সংসার ভালোই চলছিল। হঠাৎ দুই বছরের কন্যার মৃত্যুতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সুখের ঘর। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর শারীরিক-মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। বাসা থেকে বের করে দেয় স্বামী। এরপর রাস্তায়-রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান। পরে ঠাঁই মেলে এই আশ্রমে।
নূরজাহান বলেন, স্বামীর সংসারে সতীন আসায় আর জায়গা হয়নি। কিন্তু এখানে বেশ ভালো আছি। ঈদের দিন অনেক স্মৃতি মনে পড়লেও কান্না আসে না। এটাই এখন আমার আসল পরিবার।
মানবসেবায় প্রায় এক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে বৃদ্ধ মা-বাবা আছে। পরিবার থেকে বিতাড়িত, বিচ্ছিন্ন শিশুও রয়েছে। এখন তো মিডিয়ার আধুনিক যুগ, কোনো বৃদ্ধ মা-বাবার পরিবারের জন্য পোস্ট দিলে বা বিজ্ঞপ্তি দিলে অনেকে যোগাযোগ করেন।
তিনি বলেন, এখানে অনেক বাবা-মা আছেন, যাদের বেশ কয়েকজনের সন্তানরা জানেন। কিন্তু কখনও আসেন না, খোঁজও নেন না ঈদের দিন হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনক যে এখানে থাকা কোনো বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখতে আসে না কোনো পরিবার। তাই ভালো খাবার, কাপড়-চোপড়েও চাপা কষ্ট উগড়ে কেউ কেউ ভেঙে পড়েন কান্নায়।
মিল্টন বলেন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় এবার ঈদের দিনে তাদের ভালো খাবার, কাপড়-চোপড় দিয়েছি। দুটি গরু কুরবানি করেছি।
তিনি আরও বলেন, ৯৯৯ থেকে প্রায়ই কল আসে। সেখানে শিশু কখনও বৃদ্ধের সড়কে পড়ে থাকার তথ্য পাই। পরে আমরা নিয়ে আসি। ঢাকার সব থানা পুলিশের উদ্ধার করা শিশু-বৃদ্ধরা এখানে আশ্রয় পান। আজ আমাদের এখানে ১৩৫ জন বৃদ্ধ, ৩০টি শিশু থাকছে। কর্মচারী ৬০ জন। মাসে খরচ ২৮ লাখ টাকা। শুধু মাসে ওষুধ লাগে আট লাখ টাকার। কখনও কখনও খরচ পোষাতে হিমশিম খাই। তাই বিত্তবানদের প্রতি অনুরোধ— পাশে দাঁড়ান, মানবতার পাশে।
জেইউ/এসএসএইচ
পাগলিটা মা হয়েছে, বাবা হয়নি কেউ!
25 Feb | Watch Video
দেশের বৃহত্তম আশ্রম এখন হিমশিমে!
25 Feb | Watch Video
তৈরি হচ্ছে দেশের বৃহত্তম আশ্রম! এগিয়ে আসুন সবাই
25 Feb | Watch Video
তৈরি হচ্ছে ৭০০ মানুষের আশ্রয় কেন্দ্র! || Child & Old Age Care.
25 Feb | Watch Video
৭০ হাজার মানুষেরে পাশে দাঁড়িয়েছে Child & Old Age Care.
25 Feb | Watch Video