আজ বিশ্ব বাবা দিবস। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও এ দিবসটি উদযাপিত হয়। এ দিনটিতে বাবাদের নানাভাবে শুভেচ্ছা জানানো বা স্মরণ করা হয়।
বাবা দিবসের সুনির্দিষ্ঠ কোনো ইতিহাস না থাকলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে থেকে এ দিবস পালন শুরু হয়। আসলে মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল – এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে যার শুরু। ধারণা করা হয়, ১৯০৮ সালের ৫ই জুলাই, আমেরিকার পশ্চিম ভার্জেনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় এই দিনটি প্রথম পালিত হয়।
পৃথিবী অনেকখানি বদলে গেছে। ভেঙে পড়েছে পারিবারিক বন্ধন। যে মানুষটির আঙুল ধরে সন্তানের প্রথম হাঁটতে শেখা, বৃদ্ধ বয়সে সেই বাবার স্থান এখন বৃদ্ধাশ্রমে। নচিকেতার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়- ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার। মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সল্ফ্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!’।
অথচ এ সন্তানের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সব মৌলিক চাহিদার নিরাপত্তা দেওয়ার সঙ্গে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন বাবা। অসুস্থ শরীরের ক্লান্তিকে পাত্তা না দিয়ে ছুটে চলেছেন সন্তানের হাসির সন্ধানে। অন্তত, আজকের দিনটিতে সেই সন্তানেরা বুকে টেনে নেন বাবাকে। প্রকাশ করেন কৃতজ্ঞতা।
বার্তমান সময়ে বাবা দিবস আসলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে ওঠে বাবার সাথে ছবি তুলে ও ফেসবুকে আপলোড করে। কিন্তু সেই বাবাকে সারাবছর একবারও শুভেচ্ছা বা ভালবাসার কথা বলা হয় না বরং তাদের অযত্ন অবহেলায় রাস্তায় ফেলে যায় সন্তানরা। তারপর তাদের ঢাকাসহ দেশের অনেক বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয় বাবাদের।
পঁচাত্তর বছর বয়সী সেলিম চৌধুরী। বাড়ি চট্টগ্রামে। ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্ত্রী ও দুই মেয়ে সন্তানের জনক এই বৃদ্ধ হার্নিয়া রোগে ভুগছিলেন। ২০১৩ সালে অবসরে যাওয়ার পর শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হয়। হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য মাসে প্রয়োজন অনেক টাকা। তার ওপর আবার অসুস্থজনিত সেবা। যার কোনোটিই তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী বহন করছিলেন না। সেবা যত্ন নেয়ার কেউ ছিল না তার পাশে। পরে অসুস্থ এই বৃদ্ধের ঠাঁই মিরপুরের বৃদ্ধাশ্রম চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (৭০)। বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরকৈজুরী গ্রামে । পরিবারের ৩ ছেলেকে কুলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। জীবনের শেষ মুহুর্তে অসুস্থ হয়ে কাজ-কর্ম করতে না পারায় পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে যান তিনি। এক পর্যায়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার স্ত্রী ও সন্তানরা। জীবনের শেষ বয়সে ঠাঁই হলো বৃদ্ধাশ্রমে।
৬ মে মিরপুরের চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে গিয়ে দেখা হয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে। তিনি জানান, ১৯৭১ সাল থেকে নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় গার্মেন্টস্ ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন তিনি। মালিক ছিলেন ভাই ভাই রেটিং এন্ড গার্মেন্টস্ এর। আত্বীয় মামা শশুড়কে আড়াই কোটি টাকা দিয়েছিলেন মেশিন কিনতে কিন্তু সে সম্পুন্ন টাকা হাতিয়ে নেয়। সেই টাকা উত্তোলন করতে জমি বিক্রি করে অনেক মানুষকে আরও টাকা-পয়সাও দিয়েছেন কিন্তু কাজ হয়নি। তারপর খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য চাকরি নেন একটি গার্মেন্টস কোম্পানিতে। কিন্তু; সেখানে স্ট্রোক করায় আর কোনো কাজ করতে পারেনি বৃদ্ধ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারপর চলে যান বাড়িতে। সেখানে শুরু হয় নির্যাতন-বঞ্চনা। ছেলে,স্ত্রী জমি লিখে দিতে শুরু করেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ৩১ এপ্রিল সকালে গালমন্দের এক পর্যায়ে স্ত্রী স্বামী মোহাম্মদ আলীকে গালে থাপ্পর দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। দুপুরের দিকে একটি বাসে চড়ে চলে আসেন ঢাকায়। কোনো কুল কিনারা না পেয়ে একজনের পরামর্শে আসেন মিরপুরের চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে।
ঝিনাইদহে স্টোক করে প্যারালাইজড হওয়া আশরাফুল জামান (৬০) ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে যায় তার ২ সন্তান। সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে সদর থানা পুলিশ। স্থানীয় হাসপাতালে দেড়মাস চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু পরিবারের কেউ নিতে রাজি হয়নি। অতঃপর ৬ মে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি মিজানুর রহমানের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে গ্রহন করে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ জানায়, আশরাফুল জামানের দুই সন্তান উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসাবে রয়েছে সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী ঢাকার সাভারের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত। গত দেড় মাস পুর্বে ২ বছর ধরে অসুস্থ, স্টোক করে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া ছেলেরা তার পিতা আশরাফুল জামানকে রাস্তা ফেলে যায়। তারপর সদর থানা পুলিশ উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। ০৫ মে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি মিজানুর রহমানের মাধ্যমে খবর পেয়ে ৬ মে আশরাফুল জামানকে নিয়ে আসা হয় মিরপুরের চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে।
বাবার জন্য প্রতিটি দিবস, তবু বিশেষ এই দিনটিতে আসুন বলে দিই- ‘বাবা, তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তোমার কারণে আজকের এই আমি’। আর যারা বৃদ্ধাশ্রমে বাবাকে ফেলে এসেছেন, তারা একটু দেখুন না ‘মস্ত বাড়ি’তে ওই মানুষটির কোনো স্থান হয় কি-না? না হলে একটু মনে করে দেখেন বাবা কী কষ্ট করে আপনাকে ‘মস্ত অফিসার’ বানিয়েছেন। সবশেষে বিশ্ব বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবার প্রতি রইল শ্রদ্ধাবনত শুভেচ্ছা।