আজকাল বাংলা || সেপ্টেম্বর 28, 2020 - 23:370 ||
বিকাশ রায় চৌধুরীঃ কল্যাণপুর বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে এসে
জীবনটা মোর সোনার খাঁচায় রইল না’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ছন্দের সঙ্গে মিলে যায় দেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর জীবনে। আজকের এই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি কোন একদিন কোন পরিবারের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন। সময়ের বিবর্তনে তারা আজ পরিবারের কাছে বোঝা। মুখে তাদের অনিচ্ছাকৃত হাসি লেগে থাকলেও অতীতের স্মৃতি মনে পড়লে চোখ ভিজে যায় কান্নার নোনা জলে। বৃদ্ধাশ্রম গুলো স্ব-চোখে না দেখলে বুঝায় যাবে না কিভাবে কাটে বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মা গুলোর সময়। যাদের অবসর জীবনে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীদের নিয়ে কাটানোর কথা তারা এখন কর্মহীন জীবন নিয়ে বসে বসে জীবনের ইতির অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
আজ তুলে ধরবো দেশের অন্যান্য বৃদ্ধাশ্রমগুলোর মতো রাজধানীর কল্যাণপুরে অবস্থিত ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার। সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই একান্ত ব্যক্তিগত টাকায় পরিচালনা করা হয় এই বৃদ্ধাশ্রমটি।
বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৪ সালে। বর্তমানে এই বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধ-মা ও শিশু আছেন মোট ৮৬ জন। তাদের মধ্যে ১৪ জন প্রতিবন্ধী। চিকিৎসা সেবার জন্য রয়েছেন একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার ৩ জন সেবিকা পাশাপাশি ১০জন ওয়ার্ডবয় এছাড়াও আয়া ৮ জন। বৃদ্ধাশ্রমে কর্রতব্যরত ডাক্তার সপ্তাহে ২ দিন এই বৃদ্ধ বাবা-মা দের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। বৃদ্ধাশ্রমে আছেন রান্নার কাজে ২ জন রাঁধুনী।
বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক মিল্টন সমাদার এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ছয় বছর ধরে তিনি এই বৃদ্ধাশ্রমটি পরিচালনা করে আসছেন। তিনি আরও জানান, আমার একটি নার্সিং হোম সার্ভিস আছে সে হোম সার্ভিস থেকে প্রতিমাসে প্রায় ৫-৬ লক্ষ টাকা উপার্জন হয়। এ উপার্জনের টাকা থেকে আমি প্রথমে একজন অসহায় ব্যক্তিকে সাহায্য করা শুরু করি। পরবর্তীতে সদস্য সংখ্যা বেড়ে গেলে বৃদ্ধাশ্রমের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মা সংগ্রহ করা শুরু করি। বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মা রয়েছেন ৮৬ জন। মানবিক কারণেই বৃদ্ধাশ্রমটি পরিচালনা করেন বলেও জানান তিনি।
পরে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন আশ্রমের জৈষ্ঠ বৃদ্ধ চট্রগ্রামের সেলিম (৭৮)। তিনি বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন ৩ বছর যাবত। তিনি পেশায় প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক ছিলেন। উনার দুই মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর বর্তমানে তার স্থান হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে।
ফরিদপুরের বৃদ্ধা মা সেলিমা আক্তার (৭০)। তিনি এখানে তিন বছর যাবত আছেন। উনার কাছে জানতে চাইলে উনি জানান, আমার এখানে কোন সমস্যা নাই। প্রতিদিন সময় মত খাবার পাই ও চিকিৎসা সেবা পাই।
খুলনা জেলার বৃদ্ধ বাবা আব্দুল মতিন তিনি জানান, আমি এখানে ২ বছর যাবত আছি। আমার এক ছেলে ছিল ২০১২ সালে মারা গেছে। আর দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি খুলনায়। আমার স্ত্রী ২০০৭ সালে মারা গেছে। আমি ঢাকার নবাবপুরে একটা কোম্পানিতে চাকুরী করতাম। এখানে তিন বেলা খাওয়া পাই, থাকা ও চিকিৎসা সেবা পাই। কোন প্রকার সমস্যা হয় না।
বৃদ্ধ বাবা-মা দের কথা কষ্টের কথা শুনার পরে চোখের পানি ধরে রাখতে পারবেন না। আরও অনেক মা-বাবা এই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন যারা কিনা পরিবারের পরিচয় গোপন রাখেন। উনারা বলেন আমরা পরিচয় দিলে আমাদের ছেলে-মেয়ে দের মান সম্মানের হানি হবে। তবে এই বৃদ্ধাশ্রমে উনারা সব হারিয়েও বর্তমানে অনেক ভাল আছেন। কারন পরিচালক সহ অন্যান্য সকল সেবাকর্মীদের ছেলে ও মেয়ে সেবাকর্মীদের মেয়ে বলে ডাকেন উনারা। সব মিলিয়ে নতুন পরিবার ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক ভাল আছেন বলে জানান উনারা। বর্তমানে ৩৬ রুমের ২ টি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলছে এ বৃদ্ধাশ্রমটি। বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি কক্ষে রয়েছে টিভি ও ফ্যানের ব্যবস্থা। পাশাপাশি নামাজ আদায় করার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা রয়েছে।
বৃদ্ধাশ্রম চেয়ারম্যান ও পরিচালক মিল্টন সমাদার আরও জানান, প্রতিমাসে এ বৃদ্ধাশ্রমে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, খাওয়া ও কর্মচারী বেতন দিতে হয় ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার। আগে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি চাকুরীজীবি পরিবারের সদস্যরা খাবার দিয়ে যেত এই বৃদ্ধাশ্রমে। বর্তমানে করোনার পরিস্থিতির কারনে আগের মত তেমন সহযোগিতা আসে না।
বৃদ্ধাশ্রমের বর্তমান ঠিকানাঃ বৃদ্ধাশ্রম হাউস#৪৬২, রোড নং-০৮ দক্ষিন পাইকপাড়া (দুই তলা মসজিদের পাশে) মিরপুর, ঢাকা- ১২০৭।