আমি মিলটন সমাদ্দার। আমার গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরের বৈরকাঠী গ্রামে। আমি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। আমার পারিবারিক অবস্থা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। ব্যক্তি জীবনের শুরুতে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ঢাকায় চলে আসি কর্মসংস্থানের জন্য। অনেক কষ্টকর জীবনের মধ্য দিয়ে ৩ বছর ঢাকার একটি হাসপাতালের চাকরি করি পরবর্তীতে আমি রাঙ্গামাটিতে একটি মিশনারী হাসপাতাল থেকে নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। নার্সিং প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরির মাধ্যমে আমার কর্মজীবন শুরু। মাস শেষে প্রাপ্ত বেতন দিয়ে সাংসারিক খরচ বহন করা ছিল কষ্টসাধ্য। তাই ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিত্তশালী ব্যক্তিদের বাসায় তাদের প্রিয়জনদের নার্সিং সেবা দেয়া শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যেই আমার সেবার পরিসর বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে।
এরপর ব্যবসায়িক চিন্তাধারা থেকে কয়েকজন বন্ধু ও প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে গড়ে তুলি ‘মিলটন হোম কেয়ার প্রাঃ লিঃ’ নামে একটি নার্সিং এজেন্সি । যার মাধ্যমে আরও বৃহৎ আকারে বিত্তশালীদের অসুস্থ প্রিয়জনদেরকে তাদের নিজ বাসায় সেবা দেয়া শুরু করি। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মাত্র ২ বছরেই এই প্রতিষ্ঠানটিকে সাফল্যের দোড় গোড়ায় পৌছেঁ দিতে সক্ষম হই। ফিরে আসে আমার আর্থিক স্বচ্ছলতা।
কিন্তু ২০১৪ সালে আমার মনে হলো যাদের অঢেল অর্থ-সম্পদ আছে তারা তো ইচ্ছে করলেই উন্নত চিকিৎসা বা মেডিকেল সেবা গ্রহণ করতে পারেন। অথচ রাস্তায় যেসকল বৃদ্ধ মানুষদের পরে থাকতে দেখা যায়, যাদের শরীরে ঘা-পচন, দুর্গন্ধে ভরা, যারা অজ্ঞাত অবস্থায় অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন তাদের কে দেখভাল করবে? তাদেরকে কি শুশ্রূষা করবার কেউ থাকবে না?
সেই মানবিকতার বোধ থেকে রাজধানীর আগারগাঁও-এ রাস্তায় পরে থাকা একজন বৃদ্ধ বাবাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি। তার গায়েও ছিলো অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন, পায়ে ছিলো বড় আকারের পচন। যার দুর্গন্ধে প্রতিবেশীরাও অসুবিধায় পরে যায়। ফলে এই বৃদ্ধ বাবাকে আমার ভাড়া বাসায় রাখা সম্ভব হয়নি। শেষমেষ সম্পূর্ণ আলাদা একটি টিনশেট ঘর ভাড়া করে অসহায় বাবাকে আশ্রয় প্রদান করা হয়। আমার ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ততা আর আমার সহধর্মীনি সরকারি চাকুরে হওয়ায় তার দেখভালের জন্য ২ জন লোকও নিয়োগ দেই।
এভাবেই শুরু হয় পথের লোকদের ঘর পাবার গল্প। ১ জন, ২ জন করে করে যখন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো তখন ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে মনে হলো রাস্তায় পরে থাকা অজ্ঞাত, অসুস্থ, পরিবার বঞ্চিত মানুষদের এভাবে ব্যক্তিগতভাবে সেবা দেয়াটা আইনানুগ হবেনা। পথের মানুষদের সেবা দেয়ার প্রয়াশেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বৃদ্ধাশ্রম ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এর প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ১০৪৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ৩৯৫ জন হারিয়ে যাওয়া শিশু এবং ৪০ জন প্রতিবন্ধী শিশুদের আশ্রয় দিয়েছে এই ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’।
আমি মূলত সমাজের হৃদয়বান স্বেচ্ছাসেবক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাস্তায় পরে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও অজ্ঞাত শিশুদের এই প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় প্রদান করে থাকি। হারিয়ে যাওয়া শিশু ও বৃদ্ধদের পরিচয় খুঁজে পরিবারে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।
তবে আধুনিক এই শহরে অধিকাংশ সময় তাদের পরিচয় খুঁজে পাওয়া গেলেও পরিবার কিংবা তাদের অভিভাবকেরা এই সকল বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের বাসায় ফিরিয়ে নিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়। আবার শিশুদের ক্ষেত্রেও সুস্থ শিশুদের পরিবার খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ কিন্তু সমস্যা বাঁধে প্রতিবন্ধী শিশুদের বেলায়। তাদের আর ফেরা হয়না জন্মদাতাদের কোলে।
ফিরবেই বা কি করে? অভিভাবকরাই যে তাদের বাজারের ব্যাগ, মিষ্টির ঠোঙ্গা, অব্যবহৃত লাকেজে করে ফেলে যায় ডাষ্টবিনে, রাস্তার ধারে, ড্রেনে। ফলশ্রুতিতে প্রতিবন্ধী বাচ্চাগুলোকে আর ফেরত পাঠানো যায় না আপন পরিবারে। জীবন যুদ্ধের এই রক্তিম সাগরে এতটুকু বাাঁচার স্বপ্নে তারা লালিত-পালিত হচ্ছে আমার পরিচয়ে, আমার আশ্রয়ে।
তাদের মধ্যে বার্ধক্যজনীত কারণে এবং জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে ৪১৫ জন বৃদ্ধ বাবা-মা আমার আশ্রয়ে থেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদেরকে স্ব-স্ব ধর্মীয় মূল্যবোধে সম্মানের সহিত দাফন-কাফন ও সৎকারেরও ব্যবস্থা করেছে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার।
এই সকল অসহায়, পরিচয়হীন মানুষদের পরিচর্যা ও চিকিৎসায় প্রতি মাসে ব্যয় হয় প্রায় ২৫/২৮ লাখ টাকা। যার ছোট একটি অংশ আমি ব্যক্তিগত আয় ও আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ থেকে বহন করি আর বাকি বৃহৎ অংশের ব্যয়ভার বহন করা হয় দেশ ও প্রবাসের হৃদয়বান মানুষের সহযোগিতার দ্বারা। এই সেবা কার্যক্রম চলমান রাখতে হৃদয়বান মানুষদের সহযোগিতায় সাভারে নিজস্ব আবাসন, কবরস্থান এবং মসজিদ প্রকল্পের জন্য জমি ক্রয়সহ নির্মাণ করা হচ্ছে ৭ তলা বিশিষ্ট স্থায়ী আবাসন। যার নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই প্রকল্প সম্পন্ন হলে এখানে আশ্রয় পাবে পাঁচ শতাধিক অসহায় মানুষ। আমার স্বপ্ন আমার মৃত্যুর পরও চলমান থাকবে এই মহান কর্মযজ্ঞ।
একই সাথে এই চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের মাধ্যমে আমরা দেশের বিভিন্ন অসহায় মানুষদের চিকিৎসা, শিক্ষা, অজ্ঞাত মৃত ব্যক্তিদের দাফন-কাফন, দেশের বিভিন্ন দূর্যোগ ও মহামারিতে নানা ধরণের সমাজসেবামূলক কার্যক্রম করে আসছি। আমার দুইটি প্রতিষ্ঠানে দুইশতাধিক সল্প ও উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই মুহুর্ত পর্যন্ত সুবিধাভোগি মানুষের সংখ্যাও ৭০ হাজারের অধিক।
এই দীর্ঘ ৭/৮ বছরের চলমান কার্যক্রমে আমার কাজকে সমর্থন জানিয়ে প্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতায় সর্বাধিক ব্যবহৃত সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুক আইডি ও পেইজে কোটিরও অধিক মানুষ আমাদের চলার পথের সাথী হয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও সংস্থা আমার কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়ে আমার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা, ক্রেষ্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস-২০১৯’ উপলক্ষে প্রবীণদের সেবায় স্বীকৃতিস্বরূপ মানবতা ক্যাটাগরীতে প্রবীণ হিতৈষী ‘মমতাময়ী’ পুরস্কার। ২০২২ সালে যুব ও ক্রিড়া মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘সামাজিক ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠদের প্রতি আদর্শ সেবা/সমাজ কল্যাণে অসাধারণ অবদান’ ক্যাটাগরিতে ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার আ্যাওয়ার্ড-২০২২’। এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন।
আমার কার্যক্রমের সকল সফলতা, সকল প্রাপ্তি এবং পুরস্কারই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, দেশের সমস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মিডিয়া এবং সংবাদ মাধ্যমে জড়িত সকলের উদ্দেশে উৎসর্গ করছি। সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে নত-শিরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
পাগলিটা মা হয়েছে, বাবা হয়নি কেউ!
25 Feb | Watch Video
দেশের বৃহত্তম আশ্রম এখন হিমশিমে!
25 Feb | Watch Video
তৈরি হচ্ছে দেশের বৃহত্তম আশ্রম! এগিয়ে আসুন সবাই
25 Feb | Watch Video
তৈরি হচ্ছে ৭০০ মানুষের আশ্রয় কেন্দ্র! || Child & Old Age Care.
25 Feb | Watch Video
৭০ হাজার মানুষেরে পাশে দাঁড়িয়েছে Child & Old Age Care.
25 Feb | Watch Video