নূরজাহানের আকুতি, লন্ডনে বড় হওয়া ছালেমার ভাগ্য বিড়ম্বনা...
আমার তো পরিবার নেই। কিছু করতেও পারি না। এখন তো শেষ সময়। এই সময়ে যদি একটা পরিবার পেতাম তালে শেষ সময় পরিবারের সঙ্গেই কাটাতাম। বৃদ্ধ বয়সে পরিবার আশ্রয় পেতে এমনি আকুতি জানান ৮০ বছর বয়সী নুরজাহান বেগম। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। সবকিছু হারিয়ে এখন তার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে।
রাজধানীর কল্যাণপুরে একটি বৃদ্ধাশ্রমে থেকে নুরজান বেগম। প্রয় বছর ছয়েক ধরে থাকছেন সেখানে। পরিবারের কথা তেমন মনে করতে পারছেন না। সন্তান সন্ততি ছিল কিনা সেটাও জানেন না। বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার মিরাজ হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে নুরজাহান বেগম সেখানে রয়েছেন। প্রথম প্রথম বলতেন, তার বাড়ি নড়াইল জেলায়। এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারছেন না। এ পর্যন্ত তার খোঁজে কেউ আসেনি। নুরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তিনি বলেন আমার কোনো ছেলে সন্তান নেই। ভাই ছিলো সে মারা গেছে। এখানে কে নিয়ে এসেছে সেটা জানি না। তবে আমি এক্সিডেন্ট করেছিলাম। ওই সময়ে আমার পায়ে খুব সমস্যা হয়েছিলো। পরে আর কিছু মনে নেই। এখানে সবাই আমাদের খুব যত্ন নেয়। আমরা এখানে ভালো আছি।
কল্যাণপুর চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টারে গিয়ে এ রকম শতাধিক বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ মেলে। তাদের বেশির ভাগই নিজ পরিবার থেকে বিতাড়িত। তাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য নানান গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেখা মিললো চিকিৎসক, আমলা শিক্ষকেরও। জীবনের সবকিছু উজার করে তারা একদিন নিজেদের সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে উপেক্ষিত তাদের আশ্রয় হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টার’ বৃদ্ধাশ্রমটিতে ১১৪ জন বৃদ্ধ বাবা-মা রয়েছে। এছাড়া ২০ জন শিশু রয়েছে। শিশুদের বেশির ভাগই প্রতিবন্ধী। দেশে করোনার ভয়াবহতা শুরুর পর থেকে নিরাপদ স্বস্থ্যবিধি মেনে এখানকার সবাইকে সেবা দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সেখানে কেউই করোনায় আক্রান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন ম্যানেজার মিরাজ হোসেন। তিনি বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এখানে সবাই নিরপদ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। প্রয়োজন মতো চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন।
ষাটোর্ধ্ব ছালেমা আমজাদ। তার জন্ম লন্ডনে। শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে পড়ালেখা বেড়ে ওঠা সবটাই ওই শহরে। পরে বিয়ে, চার সন্তানের জননী হওয়া। সেও ওই লন্ডনে। জীবনের দীর্ঘ সময় স্বামী আর চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দময় জীবন কাটিয়েছেন ছালেমা। সন্তানরা ক্রমে বড় হয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এক পর্যায়ে খুব ভালো কাজের সুযোগ পান। চাকরি-বাকরি, সংসার, সন্তানসহ নিজেদের মতো গুছিয়ে ফেলন যার যার জীবন। শুধু তাদের কারও পরিবারে জায়গা হয়নি বয়স্ক মা ছালেমার। ছেলে-মেয়ে সবার কাছেই তিনি থেকে গেছেন উপেক্ষিত। এক পর্যায়ে লন্ডনের উন্নত জীবন ছেড়ে শূন্যহাতে চলে আসেন বাংলাদেশে বাবার জন্মভিটা খুলনায়। সেখানেও খুঁজে পাননি কোনো স্বজন। শেষমেষ এক সাংবাদিকের সহায়তায় ঠাঁই হয় চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়রা সেন্টারে। পাঁচ বছর ধরে সেখানেই কাটছে তার দিন।
এখানে কেমন আছেন জানতে চাইলে ছালেমা বলেন, বেশ ভালোই আছি। উন্নত দেশে উন্নত পরিবেশে কেটেছে আমার জীবনের বেশির ভাগ সময়। লন্ডন শহরে আমার জন্ম। সেখানেই পড়ালেখা করেছি। বিয়ে হয়েছে সে শহরেই। আমার তিন ছেলে, এক মেয়ে। তাদেরও বিয়ে হয়েছে, প্রত্যেকের ঘরে সন্তান-সন্ততি আছে। কিন্তু কারও ঘরে আমার জায়গা হয়নি। আমি জানি তাদের কথা মনে হলেও আমার কোনো লাভ নেই, এজন্য মনে করতে চাই না। যতদিন বাঁচবো এখানেই থাকবো, এটা আমার ঠিকানা। সন্তানদের কাছে আমি আর ফেরে যেতে চাই না। তারা আমার খবর নেবে, এটা আমি আর আশাও করি না।
বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মিল্টন সমাদ্দার মানবজমিনকে বলেন, আমি নার্সিংয়ের ছাত্র ছিলাম। তখন থেকে আমি অসহায় মানুষদের সেবা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতাম। পরে ২০১৪ সালে আমি এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করি। তখন মাত্র একজন ছিলেন। এখন ১৩৪ জন আছেন। আমি শেষ সময় পর্যন্ত তাদের সেবা করে যেতে চাই।